হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং যাবতীয় বিষয়!

হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ

ভাবুন, আপনি একেবারে সুস্থ আছেন- কোনও শারীরিক সমস্যা নেই, কাজকর্মে ব্যস্ত, পরিবার নিয়ে সুখেই আছেন। হঠাৎ একদিন বুকের মাঝখানটায় চাপ ধরে, ঘাম ঝরছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি ভাবলেন, হয়তো গ্যাস্ট্রিক বা ক্লান্তি। কিন্তু জানেন কি? এটাই হতে পারে হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন, যার একটি বড় অংশের কারণই হল হার্টের রক্তনালিতে ব্লক। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ মানুষই এর শুরুতেই বুঝতে পারেন না, এবং যখন বুঝেন, তখন অনেক সময়ই দেরি হয়ে যায়। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো এই ব্লকের লক্ষণ কীভাবে চিনবেন, চিকিৎসা কী এবং সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এর ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে।

বর্তমান জীবনের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত স্ট্রেস, ধূমপান, আর শরীরচর্চার অভাব- সব মিলিয়ে আমাদের হৃদযন্ত্র আজ হুমকির মুখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রতি চারটি মৃত্যুতে একটি মৃত্যু ঘটেছে হৃদরোগজনিত কারণে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত একটি সমস্যা হলো হার্টের রক্তনালিতে ব্লক। অনেকে ভাবেন, এটা শুধু বয়স্কদের সমস্যা। অথচ ৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও এখন এই সমস্যার হার দ্রুত বাড়ছে। তাই, এই আর্টিকেলে “হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ”গুলো আপনি বিস্তারিতভাবে জানবেন এবং জানতে পারবেন কোন সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ: কীভাবে চিনবেন বিপদের ইঙ্গিত? 

হালকা থেকে তীব্র বুক ব্যথা

হার্টে ব্লক তৈরি হলে সবচেয়ে সাধারণ এবং গুরুতর লক্ষণ হলো বুক ব্যথা বা “অ্যাঞ্জাইনা”। এই ব্যথাটি হালকা চাপ, ভারি অনুভূতি, বা জ্বালাপোড়া রূপে শুরু হতে পারে, যা ধীরে ধীরে তীব্র রূপ নিতে পারে। সাধারণত ব্যথা বুকের মাঝখানে অনুভূত হয় এবং এটি কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে। অনেক সময় মানুষ এটি বদহজম বা গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, কিন্তু এটি আসলে হার্টে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।

এই ব্যথা শারীরিক পরিশ্রম বা মানসিক চাপে বেড়ে যেতে পারে এবং বিশ্রামে কমে আসতে পারে। তবে, যদি ব্যথা হঠাৎ তীব্র হয় এবং বিশ্রামেও না কমে, তবে এটি হৃদ্‌রোগের মারাত্মক সংকেত হতে পারে, যেমন হার্ট অ্যাটাক। এমন ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না নিলে জীবনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই বুক ব্যথাকে অবহেলা না করে, নিয়মিত হার্ট পরীক্ষা করানো গুরুত্বপূর্ণ।

নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া

হার্টের রক্তনালিতে ব্লক হলে হৃদ্‌যন্ত্র ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না। ফলে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পৌঁছায় না এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট অনুভব হয়। সাধারণত হাঁটাহাঁটি, সিঁড়ি বাওয়া বা হালকা কাজ করার সময় নিঃশ্বাসে কষ্ট বাড়তে দেখা যায়। অনেকে মনে করেন এটি শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা, কিন্তু এর পেছনে হার্টের সমস্যা থাকতে পারে।

এই লক্ষণটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যখন তা পূর্বে না থাকলেও হঠাৎ শুরু হয় বা আগের তুলনায় বেড়ে যায়। এটি হৃদ্‌যন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাসের একটি ইঙ্গিত হতে পারে, বিশেষ করে যখন হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কমে যায়। তাই নিয়মিত নিঃশ্বাসে কষ্ট হলে, তা অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ঘনঘন ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা

শরীরের প্রতিটি কোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত না পৌঁছালে আমরা ক্লান্তি অনুভব করি। হার্টের রক্তনালিতে ব্লক থাকলে, হৃদ্‌যন্ত্র কার্যকরভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এবং আমরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ি। এমনকি সামান্য কাজেও যদি বেশি ক্লান্তি লাগে, তবে এটি হৃদরোগের একটি ইঙ্গিত হতে পারে।

এই ধরণের ক্লান্তি সব সময় সাধারণ অলসতা নয়। বিশেষ করে যদি আগে যেসব কাজ সহজে করা যেত, তা হঠাৎ করে করতে সমস্যা হয় বা বারবার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, তবে তা অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। নারীদের ক্ষেত্রে ক্লান্তি হৃদ্‌রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হতে পারে, যদিও অনেকেই এটিকে অবহেলা করেন।

ঘাম ঝরা ও মাথা ঘোরা

হৃদ্‌রোগের একটি গোপন কিন্তু ভয়ানক লক্ষণ হলো হঠাৎ অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, বিশেষ করে যখন তা ঠাণ্ডা ঘাম হয়। এই ঘাম সাধারণ শারীরিক পরিশ্রম বা তাপমাত্রার কারণে হয় না বরং এটি হার্ট অ্যাটাকের সময় শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়। অনেক সময় এই লক্ষণটি বুক ব্যথার আগেও শুরু হতে পারে।

মাথা ঘোরা বা হালকা মাথা লাগাও হৃদ্‌যন্ত্রের রক্ত সরবরাহে বাধার একটি সংকেত হতে পারে। মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত না পৌঁছালে এমন অনুভূতি হয় এবং তা অজ্ঞান হওয়ার দিকেও নিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালে যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তবে তা উপেক্ষা না করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

কাঁধ, হাত, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া

হার্টের ব্লকের ফলে যে ব্যথা শুরু হয় তা কেবল বুকে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণত এই ব্যথা বাম হাত, কাঁধ, ঘাড় বা চোয়ালে পৌঁছায়। এটি এমন একধরনের ব্যথা, যা চাপ দেওয়া বা নাড়াচাড়া করলেও পরিবর্তন হয় না, এবং একটানা থাকতে পারে। অনেক সময় ব্যথাটি হালকা হতে পারে, কিন্তু তা ধীরে ধীরে তীব্র হয়।

এই ব্যথা অনেক সময় সাধারণ পেশির ব্যথার মতো মনে হলেও, হার্টের সমস্যার কারণে হয়ে থাকলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে যখন ব্যথার সঙ্গে ঘাম, ক্লান্তি বা শ্বাসকষ্টও থাকে, তখন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। এমন লক্ষণ দেখলে দ্রুত হার্ট স্পেশালিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 কারা বেশি ঝুঁকিতে? ব্লকের প্রধান কারণগুলো জেনে নিন

উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হৃদ্‌রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। যখন রক্তচাপ দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকে, তখন রক্তনালির দেয়ালগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেখানে চর্বি জমে ব্লকের সৃষ্টি করে। এই ক্ষতিগ্রস্ত ধমনীগুলোতে প্লাক জমতে সহজ হয়, যা ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহে বাধা দেয় এবং হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।

একইভাবে, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমা হলে তা ধমনির মধ্যে জমে যায় এবং “অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস” নামে পরিচিত রোগ সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় ধমনি সরু হয়ে পড়ে, যা হার্টে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরল, যাকে ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বলা হয়, সেটি বেশি থাকলে বিপদের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। নিয়মিত রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া জরুরি।

ধূমপান ও মদ্যপান

ধূমপান হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। তামাকজাত দ্রব্যে থাকা নিকোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালির দেয়ালে ক্ষতি করে এবং ধমনি সংকুচিত করে। এটি রক্তচাপ বাড়ায় ও রক্তের অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়, ফলে হার্টে চাপ পড়ে। ধূমপান রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণকেও বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তনালিতে ব্লক তৈরিতে সহায়ক হয়। এমনকি প্যাসিভ স্মোকিং, অর্থাৎ অন্যের ধোঁয়া গ্রহণ করলেও ঝুঁকি কম নয়।

অন্যদিকে অতিরিক্ত মদ্যপানও হার্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি রক্তচাপ বাড়ায়, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড নামক চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের পেশির কার্যকারিতা হ্রাস করে। যদিও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে অল্প পরিমাণে রেড ওয়াইন উপকারী হতে পারে, তবে নিয়মিত বা অতিরিক্ত পরিমাণে মদ্যপান হার্ট ব্লকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই সুস্থ হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে পরিহার করাই উত্তম।

স্থূলতা ও অনিয়মিত জীবনধারা

স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন হৃদ্‌রোগের জন্য একটি বড় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে তা রক্তে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ এবং ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাব রক্তনালিকে সংকুচিত ও কঠিন করে তোলে, যা ব্লকের সৃষ্টি করে। স্থূল ব্যক্তিরা হাঁটাচলায় অস্বস্তি অনুভব করেন, যার ফলে তারা আরও অলস জীবনযাপন করতে শুরু করেন –  এতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

অনিয়মিত জীবনধারাও হার্টের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না, পর্যাপ্ত ঘুমান না বা সুষম খাবার খান না, তাদের হৃদ্‌রোগের সম্ভাবনা অনেক বেশি। অফিসে দীর্ঘসময় বসে থাকা, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়া- এসব আধুনিক জীবনের অভ্যাসগুলো হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। তাই প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়াবেটিস ও পারিবারিক ইতিহাস

ডায়াবেটিস থাকলে শরীরের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তনালির দেয়ালে ক্ষতি করে এবং কোলেস্টেরল জমার পথ সহজ করে তোলে। ফলে ধমনিতে ব্লক তৈরি হয় এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা প্রায়শই স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, যা মিলিতভাবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ।

পারিবারিক ইতিহাসও হৃদ্‌রোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি পরিবারের কোনো সদস্য, বিশেষ করে বাবা-মা বা ভাইবোনের হৃদ্‌রোগের ইতিহাস থাকে, তবে সেই ব্যক্তির হার্ট ব্লকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এটি জেনেটিক বা বংশগত হতে পারে, এবং এমন অবস্থায় আগে থেকেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বয়স ৩০ পার হওয়ার পর থেকে যারা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, তাদের নিয়মিত হার্ট চেকআপ করানো ও জীবনধারায় সচেতনতা বাড়ানো একান্ত দরকার।

ব্লকের প্রাথমিক লক্ষণ উপেক্ষা করলে কী হতে পারে?

হার্ট অ্যাটাক

হার্টে ব্লক থাকলে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং যদি এটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হৃদপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছায় না। এর ফলে হৃদপেশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হার্ট অ্যাটাক ঘটে। যেকোনো বয়সে, এমনকি অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যেও এখন হার্ট অ্যাটাকের হার বাড়ছে, কারণ অনেকেই ব্লকের প্রাথমিক লক্ষণকে গুরুত্ব দেন না। বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা ঘনঘন ক্লান্তি দেখা দিলেও বেশিরভাগ মানুষ তা গ্যাস বা সাময়িক দুর্বলতা ভেবে এড়িয়ে যান।

এভাবে উপেক্ষার ফলে, যখন চূড়ান্তভাবে হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন অনেক সময় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাকের পরে হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে, স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, এমনকি পুনরায় অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই যে কোনো ব্যতিক্রমী লক্ষণ হলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা হ্রাস

যদি হার্টে ব্লক ধীরে ধীরে বাড়ে এবং তা সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে হৃদপিণ্ডের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। এই অবস্থা “হার্ট ফেলিউর” বা হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা হ্রাস নামে পরিচিত। এই অবস্থায় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত রক্ত পায় না, ফলে ক্লান্তি, পা ফোলা, শ্বাসকষ্ট, ও রাতে শোয়ার সময় শ্বাস আটকে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

যেহেতু হৃদপিণ্ড মানুষের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি, তাই এর দুর্বলতা ধীরে ধীরে জীবনের মান কমিয়ে দেয়। প্রতিদিনের সহজ কাজ করতেও কষ্ট হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে ওষুধের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় থাকে না। তাই ব্লকের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অবহেলা না করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জীবনের জন্যই মঙ্গলজনক।

আকস্মিক মৃত্যু

সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো আকস্মিক মৃত্যু, যা অনেক সময় কোনো পূর্ব সংকেত ছাড়াই ঘটে যায়। অনেক মানুষ যাদের রক্তনালিতে ৭০-৯০% ব্লক ছিল, কিন্তু তারা কোনো ব্যথা অনুভব করেননি- তাঁরা হঠাৎ করেই মৃত্যু বরণ করেছেন। এটি ঘটে যখন ব্লক এতটাই গুরুতর হয় যে মুহূর্তের মধ্যে হার্ট সম্পূর্ণভাবে থেমে যায় এবং শরীর সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

এই ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেত যদি আগেভাগে নিয়মিত হার্ট চেকআপ, ইসিজি, ইকো বা এনজিওগ্রাম করানো হতো। তবে সমস্যা হলো, আমরা সাধারণত বড় বিপদ না এলে সতর্ক হই না। তাই হার্টের যেকোনো অস্বাভাবিকতা, পারিবারিক ইতিহাস বা আগের লক্ষণগুলো থাকলে তা একেবারেই অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ জীবন দ্বিতীয় সুযোগ সবসময় দেয় না।

চিকিৎসা ও সমাধান: কখন কোন ব্যবস্থা নেবেন?

ওষুধ ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন

প্রাথমিক অবস্থায় যখন হার্টে ব্লক এখনো গুরুতর হয়নি (যেমন ৩০%-৫০% ব্লক), তখন চিকিৎসক সাধারণত ওষুধ এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন। ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, ও রক্তে চর্বির মাত্রা কমানোর জন্য বিশেষ ওষুধ দেওয়া হয়। এসব ওষুধ রক্তনালির প্রদাহ কমায়, রক্ত পাতলা রাখে, এবং প্লাক গঠনে বাধা দেয়। অনেক সময় অ্যাসপিরিন বা স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এর পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চর্বিযুক্ত খাবার, লাল মাংস, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি পরিহার করে শাকসবজি, ফলমূল, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ এবং ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করলেও এই পর্যায়ের ব্লক অনেকাংশে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়। এই ধাপে জীবনধারার পরিবর্তনই সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা।

এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি

যখন উপসর্গ গুরুতর হয় বা চিকিৎসক সন্দেহ করেন যে রক্তনালিতে বড় ব্লক রয়েছে, তখন এনজিওগ্রাম করানো হয়। এটি একটি পরীক্ষা, যেখানে রক্তনালিতে ডাই ঢুকিয়ে এক্স-রে এর মাধ্যমে ব্লকের অবস্থান ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক নিশ্চিত হন কোথায়, কত শতাংশ ব্লক রয়েছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।

যদি এনজিওগ্রামের ফলে দেখা যায় যে ব্লক ৭০%-এর বেশি এবং রক্তপ্রবাহে মারাত্মক বাধা দিচ্ছে, তখন “এনজিওপ্লাস্টি” করা হয়। এটি একধরনের প্রক্রিয়া যেখানে রক্তনালির ভেতর একটি ছোট বেলুন ঢুকিয়ে ব্লক জায়গাটি চওড়া করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো এই প্রক্রিয়ায় স্টেন্টও বসানো হয়, যাতে ধমনি পুনরায় সংকুচিত না হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও দ্রুত পুনরুদ্ধারযোগ্য পদ্ধতি।

স্টেন্ট বসানো বা বাইপাস সার্জারি

যদি ব্লক একটির বেশি হয় বা এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে সমাধান সম্ভব না হয়, তখন “স্টেন্ট বসানো” হয়, যা রক্তনালির ভেতর একটি জালের মতো ধাতব বস্তু স্থাপন করে ধমনিকে খোলা রাখতে সাহায্য করে। স্টেন্ট সাধারণত তখনই দেওয়া হয় যখন ব্লক স্থায়ীভাবে খুলে রাখতে হয়, বিশেষ করে যখন ধমনির অংশটি সরু বা অস্থির হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, যদি ব্লক একাধিক ধমনিতে, দীর্ঘ অংশজুড়ে অথবা জটিল জায়গায় হয়, তখন “বাইপাস সার্জারি” করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় শরীরের অন্য একটি সুস্থ রক্তনালি (সাধারণত পা বা বুক থেকে নেওয়া) হার্টের ব্লক অংশ বাইপাস করে যুক্ত করা হয়, যাতে রক্তপ্রবাহ অন্য পথে পৌঁছায়। এটি একটি বড় সার্জারি হলেও দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল দেয় এবং জীবনের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।

উপসংহার

হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের লক্ষণ নিয়ে সচেতনতাই পারে আমাদের জীবন বাঁচাতে। সময়মতো লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলে হার্ট অ্যাটাক বা মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, হার্ট আমাদের শরীরের প্রধান চালিকাশক্তি, আর তার রক্তনালিগুলো হচ্ছে প্রাণের সেতু। তাই এগুলো যত্নে রাখা আমাদের দায়িত্ব। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন রয়েছে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, স্টেন্ট বসানো থেকে শুরু করে বাইপাস সার্জারি পর্যন্ত অনেক সমাধান। কিন্তু তার আগে দরকার সচেতনতা এবং দ্রুত পদক্ষেপ। এই লেখাটি যদি আপনাকে বা আপনার পরিচিত কাউকে এই বিষয়ে সাবধান করে তোলে- তবেই আমাদের আজকের প্রচেষ্টাটি সফল হবে। আপনার হার্টের যত্ন নিন, কারণ একটি সুস্থ হার্ট মানেই একটি সুস্থ জীবন।

Related posts

Leave a Comment